দোয়া কবুল না‌ হওয়ার কারন

আপনি যদি দোয়া কবুল না হওয়ার কারণ বা যেসব কারণে দোয়া কবুল হয় না সেই সম্বন্ধে জানতে চান তাহলে আজকের আর্টিকেলটি সম্পন্ন পড়ুন।

আজকের আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়লে আপনারা দোয়া কবুল না হওয়ার কারণ গুলো জানতে পারবেন। এছাড়াও বান্দা যখন আল্লাহর কাছে দোয়া করে তখন আল্লাহ সেই দোয়ার বদলে বান্দাকে যে তিনটি জিনিস দেয় সেই সম্বন্ধেও জানতে পারবেন।

প্রত্যেক মুসলমানই আল্লাহর কাছে কিছু না কিছু চেয়ে থাকেন। তাদের মধ্যে থেকে কারো দোয়া কবুল হয় আবার কারো হয় না। আর যাদের দোয়া কবুল হয় না তাদের দোয়া কবুল না হওয়ার পিছনে অবশ্যই কোনো না কোনো কারণ থাকে। আমরা অনেকেই আছি যারা আল্লাহর কাছে অনেক দোয়া করে থাকি। কিন্তু আমাদের দোয়া কবুল হয় না। আর বারবার আমাদের দোয়া কবুল না হওয়ার কারণে আমরা দোয়া করা ছেড়ে দেয় আর হতাশ হয়ে পড়ি। হতাশ হবেন না, যাদের দোয়া কবুল হয় না তাদের জানা দরকার যে,দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা বান্দাকে তিনটি বিষয়ের কোনো একটি দিয়ে থাকেন। সেই তিনটি বিষয়গুলো হচ্ছে:-

এক. হয়তো প্রত্যাশিত বিষয়টি দিয়ে দেন।

দুই. দোয়ার বদৌলতে আল্লাহ তায়ালা তার ওপর থেকে সমপর্যায়ের বিপদ দূর করেন।

তিন. দোয়ার সওয়াব আল্লাহ তায়ালা আখেরাতে তাকে দান করবেন।তাই আপনার দোয়া কবুল না হলে হতাশ হবেন না।

আরও পড়ুন: দোয়া কুনুত বাংলা উচ্চারণ ও অর্থসহ

দোয়া কবুল না হওয়ার কারণ?

বিভিন্ন কারণে আমাদের দোয়া কবুল হয় না। আসুন সেই কারণগুলো জেনে নেওয়া যাক।

  • 1.পানাহার ও পোশাক হালাল না হওয়া
  • 2.দোয়ায় ইখলাস ও নিষ্ঠাহীনতা
  • 3.গুনাহ করা ও রক্তের বন্ধন ছিন্ন করার দোয়া
  • 4.গুনাহে অবিচলত থাকা
  • 5.দোয়ায় অমনোযোগী হওয়া
  • 6.দোয়া কবুলের জন্য তাড়াহুড়া করা
  • 7.সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে না করা
  • 8.দ্রুত ফল না পাওয়ায় দোয়া বন্ধ করে দেওয়া
  • 9.হারাম থেকে বেঁচে না থাকা
  • 10.মহান আল্লাহর প্রজ্ঞা

এক. পানাহার ও পোশাক হালাল না হওয়া

হারাম উপার্জন ও হারাম খাওয়ার কারণে মানুষের দোয়া কবুল হয় না। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:- ‘আল্লাহ পবিত্র; তিনি কেবল পবিত্র বস্তুই গ্রহণ করেন।… তিনি এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেন— দীর্ঘ সফরের ফলে যার চুল উসকোখুসকো, চেহারা ধুলোবালিমাখা। সে হাত দুটো আকাশের দিকে উঠিয়ে বলছে, ‘হে আমার রব! হে আমার রব!’, কিন্তু তার খাবার হারাম, পানীয় হারাম, পোশাক হারাম আর তার পরিপুষ্টি হয়েছে হারাম দিয়ে; (এমতাবস্থায়) কীভাবে তার দোয়ায় সাড়া দেওয়া হবে?’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১০১৫)

রাসুল (সা.) আরও বলেছেন, ‘মানুষের ওপর এমন এক যুগ অবশ্যই আসবে, যখন মানুষ পরোয়া করবে না যে কিভাবে সে সম্পদ অর্জন করল, হালাল উপায়ে, নাকি হারাম উপায়ে!’ (বুখারি, হাদিস : ২০৮৩)

অন্য হাদিসে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ পবিত্র, তিনি পবিত্র ও হালাল বস্তু ছাড়া গ্রহণ করেন না।’ (মুসলিম, হাদিস : ২২৩৬)

তাই দোয়া কবুল হওয়ার জন্য অবশ্যই হালাল ভক্ষণ করতে হবে। হালাল উপায়ে উপার্জন করতে হবে। জেনে রাখা উচিত যে, সফরে দোয়া কবুল হয়, হাত উঠিয়ে দোয়া করলে কবুল হয় এবং নিজেকে হীনজ্ঞান করে আল্লাহকে কায়মনো বাক্যে ডাকলেও দোয়া কবুল হয়; কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়— এতগুলো শর্ত লোকটি পূরণ করার পরও তার দোয়া কবুল হচ্ছে না। আর তা কেবল হারাম খাবার, পানীয় ও পোশাকের জন্য। (ইবনু রজব হাম্বলি, জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম)

দুই. দোয়ায় ইখলাস ও নিষ্ঠাহীনতা

কেউ যখন আল্লাহর কাছে দোয়া করবে তখন ইখলাস ও নিষ্ঠাহীনতার সাথে দোয়া করতে হবে।রাসুল (সা.) বলেছেন, দোয়াও একটি ইবাদত। (আবু দাউদ, হাদিস : ১৪৭৯)

ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তাদের শুধু এ নির্দেশই দেওয়া হয়েছিল যে তারা যেন আল্লাহর ইবাদত করে তাঁরই জন্য দ্বিনকে একনিষ্ঠ করে এবং নামাজ কায়েম করে ও জাকাত প্রদান করে। আর এটাই সঠিক দ্বিন।’ (সুরা বায়্যিনাহ, আয়াত : ০৫)

দোয়া করার সময় আমাদের মনে রাখতে হবে যে দোয়াও একটি ইবাদত। তাই অবশ্যই ইখলাস ও নিষ্ঠাহীনতার সাথে দোয়া করতে হবে। তাছাড়া আমাদের দোয়া কবুল হবে না।

তিন. গুনাহ করা ও রক্তের বন্ধন ছিন্ন করার দোয়া

আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা একটি মহাপাপ বা অপরাধ। এর শাস্তি আখিরাত ও দুনিয়াতে খুবই ভয়াবহ।হাদিসে এসেছে, ‘কোনো মুসলিম দোয়া করার সময় কোনো গুনাহের অথবা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নের দোয়া না করলে অবশ্যই আল্লাহ তাকে এ তিনটির কোনো একটি দান করেন।

১) হয়তো তাকে তার কাঙ্ক্ষিত সুপারিশ দুনিয়ায় দান করেন। (২) অথবা তা তার পরকালের জন্য জমা রাখেন। (৩) অথবা তার কোনো অকল্যাণ বা বিপদাপদ তার থেকে দূরে করে দেন।

সহাবিরা বলেন, তাহলে তো আমরা অনেক বেশি লাভ করব। তিনি বলেন, আল্লাহ এর চেয়েও বেশি দেন। (আত-তারগিব, হাদিস : ১৬৩৩)

চার. গুনাহে অবিচলত থাকা

দোয়া কবুল হওয়ার একটি শর্ত হচ্ছে গুনাহ থেকে বেরিয়ে আসা। আমাদের গুনাহ থেকে বেরিয়ে এসে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে। তাহলে অবশ্যই আমাদের দোয়া কবুল হবে। আমাদের নিজে থেকে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে। কারন:-আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত কোন মানুষকে বদলায় না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই মানুষ নিজে থেকে পরিবর্তন হতে না চায়।

পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা নিজেরা পরিবর্তন করে। আর কোনো সম্প্রদায়ের জন্য যদি আল্লাহ অশুভ কিছু ইচ্ছা করেন, তবে তা রদ হওয়ার নয়। এবং তিনি ছাড়া কোনো অভিভাবক নেই। (সুরা রাদ, আয়াত : ১১)

রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘বান্দার দোয়া সর্বদা গৃহীত হয় যদি না সে অন্যায় কাজ অথবা আত্মীয়তার সম্পর্কচ্ছেদ করার জন্য দোয়া করে এবং দোয়ায় তাড়াহুড়া করে। (মুসলিম, হাদিস : ৬৮২৯)

পাঁচ. দোয়ায় অমনোযোগী হওয়া

দোয়া করার সময় কোন ব্যক্তি অমনোযোগী থাকলে তার দোয়া কবুল হয় না। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা কবুল হওয়ার পূর্ণ আস্থা নিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করো, তোমরা জেনে রাখো যে আল্লাহ নিশ্চয়ই অমনোযোগী ও অসাড় মনের দোয়া কবুল করেন না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৪৭৯)

ছয়. দোয়া কবুলের জন্য তাড়াহুড়া করা

আমাদের দোয়া কবুলের জন্য তাড়াহুড়া করা উচিত না। দোয়া করে কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের দোয়া কবুল না হলে আমরা হতাশ হয়ছ পড়ি। অনেকেই বলতে শুরু করি যে আমাদের দোয়া কবুল হয়নি। এমনটা করলে আল্লাহ আমাদের উপর অসন্তুষ্ট হয়। দোয়া করার পর আমাদের দোয়া কবুলের জন্য ধৈর্য ধরা উচিত।

রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের প্রত্যেক ব্যক্তির দোয়া কবুল হয়ে থাকে। যদি সে তাড়াহুড়া না করে এবং এ কথা না বলে যে আমি দোয়া করলাম, কিন্তু আমার দোয়া তো কবুল হলো না।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৩৪০)

সাত. সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে না করা

রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, ‘শপথ সেই সত্তার, যার হাতে আমার প্রাণ! তোমরা অবশ্যই ভালো কাজের আদেশ দিবে ও অন্যায় কাজ হতে বাধা প্রদান করবে। নতুবা, অচিরেই এর ফলে আল্লাহ্ তোমাদের উপর শাস্তি পাঠাবেন। এরপর তোমরা তার কাছে দোয়া করবে, কিন্তু তোমাদের দোয়া সাড়া দেওয়া হবে না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২১৬৯)

অর্থেব আমাদের সৎ কাজে অন্যদেরকে আদেশ করতে হবে এবং অসৎ কাজে না করতে হবে। এমন গুণ আমাদের ভেতর না থাকলে আমাদের দোয়া কবুল হবে না।

আট. দ্রুত ফল না পাওয়ায় দোয়া বন্ধ করে দেওয়া

দোয়া করার পর কিছুদিনের মধ্যে আমরা যখন ফলাফল পাইনা তখন আমরা হতাশ হয়ে যাই এবং দোয়া করা বন্ধ করে দিয়। আমাদের এমনটা করা উচিত নয়। এমনটা করলে আল্লাহ আমাদের উপর অসন্তুষ্ট হয়। দ্রুত ফল না পাওয়ার পরেও আমাদের দোয়া করা চালিয়ে যেতে হবে।

রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ আল্লাহকে ডাকলে, তার ডাকে সাড়া দেওয়া হবে, যতক্ষণ না সে অধৈর্য হয়ে বলে ওঠে— ‘আল্লাহকে তো ডাকলাম, কিন্তু কোনো সাড়া তো পাওয়া গেলো না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৩৪০)

নয়. হারাম থেকে বেঁচে না থাকা

যারা হারাম খান হারাম বস্ত্র পরেন তাদের দোয়া কবুল হবে না। দোয়া কবুলের একটি শর্ত হচ্ছে হারাম থেকে বেঁচে থাকা।রাসুল (সা.) এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেন, দীর্ঘ সফরের ক্লান্তিতে যার মাথার চুল বিক্ষিপ্ত, অবিন্যস্ত ও সারা শরীর ধুলামলিন। সে আসমানের দিকে হাত প্রশস্ত করে বলে, হে আমার প্রভু! হে আমার প্রতিপালক! অথচ তার খাদ্য ও পানীয় হারাম, তার পোশাক হারাম, তার জীবন-জীবিকাও হারাম। এমতাবস্থায় তার দোয়া কিভাবে কবুল হতে পারে? (তিরমিজি, হাদিস : ৮৯৬৯)

দশ. মহান আল্লাহর প্রজ্ঞা

তিনি দোয়া সাথে সাথে কবুল না করে প্রার্থিত বস্তুর চেয়েও অধিক দেওয়ার জন্য রেখে দেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখনই কোনো মুসলিম পাপ ও আত্মীয়তা সম্পর্ক নষ্ট করা ছাড়া অন্য যে কোনো বিষয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে, তখনই আল্লাহ তার প্রার্থনা পূরণ করে তাকে তিনটি বিষয়ের একটি দান করেন: হয় তার প্রার্থিত বস্তুই তাকে দিয়ে দেন অথবা তার দোয়াকে তার আখিরাতের জন্য সঞ্চয় করে রাখেন কিংবা দোয়ার পরিমাণ অনুসারে তার অন্য কোনো (অনাগত) বিপদ তিনি দূর করে দেন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৫/৫৬৬; আহমাদ, হাদিস : ৩/১৮)

আরও পড়ুন: অযুর দোয়া ও নিয়ত

শেষ কথা

এই ছিল আজকের আর্টিকেলে। আশা করি আপনারা বুঝতে পেরেছেন যে দোয়া কবুল না হওয়ার কারণ গুলো কি কি। এবং ভবিষ্যতে সেগুলো মাথায় রেখে দোয়া করবেন। তাহলে অবশ্যই আল্লাহ তাআলা আপনাদের দোয়া কবুল করবেন।আমীন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *